লিখেছেন: চঞ্চল আশরাফ
প্রকাশের চার বছর পূর্ণ হওয়ার বেশ আগেই, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর নারী (১৯৯২) নিষিদ্ধ করে তখনকার গণতান্ত্রিক(!) সরকার। ধর্ম ব্যবসায়ী, প্রতিক্রিয়াশীল, কুসংস্কারাচ্ছন্নদের জন্য বিপজ্জনক হুমায়ুন আজাদের (১৯৪৭-২০০৪) আরও কয়েকটি বই নিষিদ্ধ হতে পারত। যেমন– হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ (১৯৯২), প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নীচে (১৯৯২), শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭), আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭), রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮), ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য (২০০৪), পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪) ইত্যাদি। ডানপন্থী বিএনপি-জামায়াত সরকার শেষ বইটি নিষিদ্ধ করতে পারত আনন্দের সঙ্গে, তারা তা করেনি। না করার কারণ, তারা সম্ভবত বুঝে গিয়েছিল : এক. বই নিষিদ্ধ করা মানে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলা; দুই. নিষিদ্ধ বই খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সমাজের সহানুভূতি লেখকের পক্ষে চলে যায়; তিন. এটা খুব ক্ষণস্থায়ী, শেষ পর্যন্ত কোনো বই-ই নিষিদ্ধ রাখা যায় না। যেমন যায়নি বেশি দিন নারী নিষিদ্ধ রাখা; ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ বাংলাদেশের উচ্চ বিচারালয় ওই আদেশ অবৈধ ঘোষণা করলে পরের মাসেই বইটির তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ বেরোয়। নারী নিষিদ্ধ রাখা বেশি দিন সম্ভব হয়নি সেই সরকারের পক্ষে, অন্য বইগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটত। তাহলে বিপজ্জনক হুমায়ুন আজাদকে নিষিদ্ধ করাই ছিল তাদের জন্যে জরুরি; কিন্তু রাষ্ট্রের অত শক্তি ছিল না; কখনও থাকে না; রাষ্ট্র একনায়কচালিত ফ্যাসিস্ট আর উগ্র মৌলবাদী হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তবে সেই সরকারের মধ্যে ছিল ফ্যাসিস্ট মনোভাব আর উগ্র মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ীদের খুব শক্তিমান একটা অংশ, যারা হুমায়ুন আজাদকে থামিয়ে দিতে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছিল।
নারী কেন নিষিদ্ধ হয়েছিল? বই নিষিদ্ধ হওয়ার থাকে অনেক কারণ। যে কারণ দেখিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়, সেটি লক্ষ করলেই বোঝা যায় তখনকার ক্ষমতাধরদের মনোভাব, রাষ্ট্র কতটা দুর্বল, অসহায় আর পশ্চাৎপদ। অনেক বই আছে যেগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ বেশ হাস্যকর। যেমন–জর্জ অরওয়েলের (১৯০৩-১৯৫০) নাইনটিন এইটি ফোর (১৯৪৯) সোভিয়েত সরকার নিষিদ্ধ করে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে; স্ট্যালিনের মনে হয়েছিল বইটিতে তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আর যুক্তরাজ্যেও এটি নিষিদ্ধ ছিল ষাটের দশকের শুরুতে এবং কিছু কাটছাঁটের পর পতনোন্মুখ সোভিয়েত ইউনিয়নে বইটি প্রকাশের অনুমতি পায় ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে। স্ট্যানলি ওলপার্টের জিন্নাহ অব পাকিস্তান (১৯৮৪) বইটি পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল জিন্নাহ শুয়োরের মাংস খেয়েছেন আর মদ্যপান করেছেন এই তথ্য তাতে ছিল বলে; অরুন্ধতি রায়ের গড অব স্মল থিংস (১৯৯৬) খ্রিস্টান মহিলার সঙ্গে নিম্নবর্ণের হিন্দুর যৌনকর্মের দৃশ্য বর্ণনার অভিযোগে ভারত সরকার নিষিদ্ধ করে। এমন বইও রয়েছে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর সেটি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে! আলেক্সান্দর সোলঝেনিৎসিনের (১৯১৮-২০০৮) দ্য গুলাগ আর্কিপিল্যাগো (১৯৭৩-৭৮) সোভিয়েত সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়; ২০০৯ সালে রাশিয়া সরকার এই নিষেধাজ্ঞা কেবল প্রত্যাহারই করেনি, রাশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুল কারিকুলামে বইটি অন্তর্ভুক্তও করে। নাদিন গর্ডিমারের উপন্যাস জুলাই'স পিপল (১৯৮১) দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার নিষিদ্ধ করলেও এখন তা সেদেশের স্কুলের পাঠ্যসূচিতে জায়গা করে নিয়েছে।
কেন নারী নিষিদ্ধ হয়েছিল? বেদনাদায়ক ও হাস্যকর বইটি নিষিদ্ধ করার আদেশপত্রে যে সহকারী সচিব স্বাক্ষর করেছিলেন, তিনি একজন নারী। ওই আদেশপত্রে বলা হয়, "পুস্তকটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি তথা মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী আপত্তিকর বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় সরকার কর্তৃক ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ 'ক' ধারার ক্ষমতাবলে বর্ণিত পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত হইল।" এর সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় দুই পাতার একটি সুপারিশ। দ্বীনি দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক_ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এ দুটি বিশেষজ্ঞ থেকেই আসে সুপারিশটি। এরা নারী থেকে ১৪টি বাক্য উদ্ধৃত করে বইটি বাজেয়াপ্ত করার পরামর্শ দেয়। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন,
এত বড় বই পড়ার শক্তি ওই দুই মৌলবাদীর ছিল না; তারা বইটি থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে পরামর্শ দেয় নিষিদ্ধ করার।
বাক্যগুলোর মধ্যে ছিল– ‘নারীর প্রধান শত্রু মৌলবাদ’; '১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে সৌদি আরবের মতো আদিম পিতৃতন্ত্রও নারীদের ঘর থেকে বের করে লাগিয়েছে নানা কাজে' ইত্যাদি বাক্য। কিন্তু এ ধরনের বাক্য পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই ছাপা হয়ে থাকে এবং উদ্ধৃত বাক্যগুলো একটা বই নিষিদ্ধ করার অজুহাত হিসেবে খুবই দুর্বল। নারীতে এগুলোর চেয়ে তীক্ষ্ন ও আক্রমণাত্দক বাক্য যথেষ্ট রয়েছে; কিন্তু পরামর্শকরা পুরো বই পড়েনি বলে সেসব বের করতে পারেনি। হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছিলেন, 'এত বড় বই পড়ার শক্তি' ওদের ছিল না। ওই নিষেধাজ্ঞার ভিত্তি যে কত হাস্যকর ও নিরীহ, সেই বাক্যগুলো পড়লে বোঝা যায়; কিন্তু ওই নারী সহকারী সচিব তা বুঝতে পারেননি। এ-ও মর্মান্তিক যে, রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী ক্ষমতা তখন যাঁর হাতে, তিনিও একজন নারী! 'নিষিদ্ধ নারী মুক্ত নারী' শীর্ষক রচনায় হুমায়ুন আজাদ জানিয়েছেন, আদালতে 'বামন কুৎসিত মৌলবাদী একটি লোক' তাঁর সঙ্গে দেখা করে এবং জানায় যে, তার আবেদনেই নিষিদ্ধ হয়েছে নারী। কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রতীকী : বামন লোকটি কেবল সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগমনের পথরোধকারী নয়, সে প্রতিনিধিত্ব করছে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বামনত্বের; আরও বলা চলে, একটি গ্রন্থের চেয়ে নির্বোধ বামনের মূল্য সরকারের কাছে বেশি; ফলে সরকার তার আবেদনে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
ধর্মীয় অনুভূতির চেয়ে নারীতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে পুরুষতন্ত্র। ধর্ম পুরুষতন্ত্রের খুব অনুগত সন্তান; তাকে দিয়ে বলানো হয়েছে নারী এক অবাধ্য বাঁকা হাড়, যে স্বর্গে সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা। পুরুষতন্ত্র নারীর সংজ্ঞা তৈরি করেছে, নির্ধারণ করেছে তার অবস্থান, তার ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য তৈরি করেছে নিষ্ঠুর সব বিধি, তাকে কামসঙ্গী ও পরিচারিকা বানিয়ে তুলেছে। ধর্ম এতে খুব কাজে লেগেছে পুরুষদের। ফলে পুরুষতন্ত্র আক্রান্ত হলে বিপদটা ধর্মের ওপরও এসে পড়ে। নারীতে ঘটেছে এমনটিই। রাষ্ট্র পুরুষতান্ত্রিক হলে সেখানে এ বই নিষিদ্ধ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বিএনপি-জামায়াত সরকার তাদের পতনের আগে তাড়াহুড়ো করে বইটি নিষিদ্ধ করে। ভাবা গিয়েছিল, নতুন সরকারের সময়ে বইটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ত্বরান্বিত হবে; আদৌ তা হয়নি এবং বেশ দেরিতে, আরেকটি মাৎস্যন্যায় আসার কিছু আগে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ দুজন বিচারপতি রায় দেন, নারী নিষিদ্ধকরণ আদেশ অবৈধ। অধিকারহীনতার এই দেশের প্রেক্ষাপটে রায়টি ছিল যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক; কিন্তু প্রচার মাধ্যমগুলোর কাছে এর কোনো গুরুত্ব ছিল না। আমাদের প্রচার মাধ্যমগুলো জনপ্রিয়তার ভীষণ কাঙাল, কিন্তু সাংস্কৃতিক দায়িত্বের সঙ্গে যে এর একটা গভীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তা বোঝার ইচ্ছা বা সামর্থ্য এগুলোর নেই।
ধর্মানুভূতিতে আঘাতের কারণ দেখিয়ে নিষিদ্ধ হওয়া বইয়ের অভাব পৃথিবীতে নেই। ড্যান ব্রাওনের দি দ্য ভিঞ্চি কোড (২০০৩) নিষিদ্ধ হয় লেবাননে, ক্রিশ্চিয়ানিটির ওপর আঘাতের অজুহাতে; সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস (১৯৮৮) নিষিদ্ধ হয় বাংলাদেশ, মিসর, ভারত, ইরান, কেনিয়া, কুয়েত, লাইবেরিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, পাকিস্তান, সেনেগাল, সিংগাপুর, শ্রীলংকা, তানজানিয়া ও থাইল্যান্ডে; জর্জ অরওয়েলের পলিটিক্যাল নভেলা অ্যনিমেল ফার্ম (১৯৪৫) কেনিয়ায় নিষিদ্ধ হয় ১৯৯১ সালে, কারণ এতে ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের সমালোচনা। ২০০২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্কুলে নিষিদ্ধ হয় বইটি। উপন্যাসটি রাজনৈতিক হলেও নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়, এতে এমন কিছু রয়েছে, যা ইসলাম এবং আরব মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যায়। এ রকম বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে।
নিষিদ্ধ বই মানেই বিখ্যাত এবং এর লেখক শেষ পর্যন্ত খুবই ভাগ্যবান। যুগে যুগে এসব বই সমাজকে এগিয়ে দিয়েছে; যদিও সমাজ তা বুঝতে পারেনি বা অনেক পরে টের পেয়েছে। নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা বেশ দীর্ঘ। এগুলোর মধ্যে অল্প কয়েকটির কথা উল্লেখ করা হলো; নিষিদ্ধ হওয়ার কারণও বলা হলো খুব সংক্ষেপে : এরিখ মারিয়া রেমার্কের (১৮৯৮-১৯৭০) উপন্যাস অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট (১৯২৯) নিষিদ্ধ করেছিল সে সময়ের জার্মান সরকার, নাজিদের 'ডিমোর্যালাইজড' করার অজুহাতে; জেমস জয়েসের (১৮৮২-১৯৪১) ইউলিসিস (১৯২২) সেক্স কন্টেন্টের জন্যে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে; বর্ণবাদের বিরুদ্ধাচরণের কারণে নাদিন গর্ডিমারের বার্গারস ডটার (১৯৭৯) প্রকাশের বছরেই নিষিদ্ধ করে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার; অবসিনিটির অজুহাতে জন ক্লেল্যান্ডের (১৭০৯-১৭৮৯) ফ্যানি হিল (১৭৪৯) আমেরিকায় নিষিদ্ধ হয় দু'বার_১৮২১ ও ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে; ভ্লাদিমির নবোকভের (১৮৯৯-১৯৭৭) লোলিটা (১৯৫৫) নিষিদ্ধ হয়েছিল অবসিনিটির কারণ দেখিয়ে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড আর সাউথ আফ্রিকায়; গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের (১৮২১-১৮৮০) মাদাম বোভারি (১৮৫৭) জনসাধারণের নৈতিক স্খলনে উৎসাহের অজুহাতে; ফ্রানৎস কাফকার (১৮৮৩-১৯২৪) মেটামরফোসিস (১৯১৫) নাজি ও কমিউনিস্ট কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়। যে বইগুলোর উল্লেখ করা হলো, প্রায় সবকটিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।
মজার ব্যাপার, কোনো বই পৃথিবীর সব দেশে নিষিদ্ধ হয় না; একটি রাষ্ট্রের সর্বত্রও হয় না। তসলিমা নাসরিনের লজ্জা (১৯৯৩) ভারতের কোনো কোনো প্রদেশে নিষিদ্ধ হয়। হাস্যকর, যারা নিষিদ্ধ করে, তারা বুঝতে পারে না বইটি কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ পড়ছে বা পড়বে। তাদের বোঝার ক্ষমতা নেই যে একদিন ঠিকই বইটি পরিণত হবে অবশ্য বা জরুরি পাঠ্যে; একদিন তারা সমাজের জন্য ঘৃণা, করুণা আর লজ্জার বিষয় হয়ে উঠবে। তারা সেই কুৎসিত বামনের বংশধর, যারা বারবার জ্ঞান ও শিল্পকলার পথরোধ করে দাঁড়ায়। তবে এই বাধা খুব ক্ষণস্থায়ী।
[ লেখাটি অনলাইন থেকে পুনঃপ্রকাশ করা হল৷ ]
0 মন্তব্যসমূহ
মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।