অনুপম দেব, কানুনজ্ঞ, ডয়েচে ভেলেঃ
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়' নামে একটি গান ছিল, যেখানে অভিনেতা উৎপল দত্ত হীরক রাজার ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করেছেন৷ গানের অংশটিতে দেখা যায় গায়ক গান গাইছেন, রাজা সুন্দর সেই কণ্ঠে মোহিত হয়ে ছন্দে ছন্দে মাথা দোলাচ্ছেন৷ এক পর্যায়ে ‘বাহ, খাসা' বলে গায়কের প্রশংসা করতেও শোনা যায় হীরক রাজাকে৷
কিন্তু যখনই গানের কথায় ‘মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে' অংশটুকু আসে, রাজার মুখের অভিব্যক্তি পালটে যায়৷ আমাত্যরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন৷ এক পর্যায়ে ধমক দিয়ে গান থামিয়ে দেন রাজা৷ টেবিল চাপড়ে বলে ওঠেন, “এ গান বন্ধ৷ এর মুখ বেঁধে ফেলো, হাত-পা বেঁধে ফেলো, বেঁধে বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলো৷”
রাজা-রাজড়াদের তুষ্ট করা, না করতে পারলে গর্দান যাওয়ার ইতিহাস অনেক পুরনো৷
উইলিয়াম শেকসপিয়ারকে বিবেচনা করা হয় ইংরেজি সাহিত্যের সেরা সাহিত্যিক হিসেবে, বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকার হিসেবে৷ তার হেমলেট, ম্যাকবেথ, মার্চেন্ট অব ভেনিস, রোমিও জুলিয়েটের মতো নাটক বিশ্বের সব দেশেই পাঠ্য৷ এমন কোনো ভাষা হয়তো নেই, যে ভাষায় শেকসপিয়ারের সাহিত্য অনুবাদ হয়নি৷
শেকসপিয়ারের এসব সাহিত্যকর্মে ছিল সরাসরি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা৷ রানি প্রথম এলিজাবেথ এবং রাজা প্রথম জেমসের আনুগত্য নিয়েই সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি৷ ম্যাকবেথ নাটকটিও রচনা হয়েছে রাজা প্রথম জেমসকে খুশি করার লক্ষ্যেই৷ জেমসকে বিজয়ী পক্ষে রেখেই সাজানো হয়েছে নাটকের গল্প৷ কোনো কোনো গবেষক মনে করেন জেমস নিজেই এই নাটকটি লিখতে শেকসপিয়ারকে আদেশ দিয়েছিলেন৷
বর্তমান যুগে ম্যাকবেথ অসাধারণ সৃষ্টি বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু তখন যারা রাজার বিরোধীতাকারী ছিলেন, তারা শেকসপিয়ারকে কেমন দৃষ্টিতে দেখতেন?
যুগ যুগ ধরে সাহিত্যকর্ম এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই এগিয়েছে৷ আরাকান রাজসভায় স্থান না পেলে মহাকবি আলাওল পদ্মাবতী কাব্য লিখতেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে৷ উল্লেখ্য, এ কাব্য আরাকান রাজার আমাত্য মাগন ঠাকুরের নির্দেশেই রচনা করেছিলেন আলাওল৷
আধুনিক যুগেও এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি৷ এমনকি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রতিভূ বলে ধরে নেয়া হয় যাদের, তাদের ক্ষেত্রেও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে৷
বর্তমান সাহিত্যিকরাও কী এর ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন? প্রকাশনা শিল্প এখন আরো অনেক জটিল হয়েছে৷ সাহিত্য প্রকাশনা এখন অনেকটাই বইমেলা কেন্দ্রীক হয়ে পড়েছে৷ ফলে সাহিত্য মুল্য কতোটুকু, তার চেয়ে অনেকাংশে বড় হয়ে উঠছে বিক্রয় মূল্য৷
বইমেলায় কেমন বই প্রকাশ করা যাবে, কেমন যাবে না, সেটিও নাকি নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ বাংলা একাডেমি তো বটেই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এখন বইয়ের ‘কনটেন্ট' নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে চায়৷ আগের যুগে ছিলেন রাজা-সম্রাট, এখন তৈরি হয়েছে নানা সিন্ডিকেট৷ সাহিত্য পুরষ্কার ও বুক রিভিউয়ের নামে নিজেদের সিন্ডিকেটের সাহিত্যিককে প্রচার করা, অন্যদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা রয়েছে একদিকে৷ অন্যদিকে বিপুল অর্থ শক্তি নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে প্রকাশনা শিল্প নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করারও চেষ্টা চলছে৷
বর্তমান প্রজন্ম থেকে কালোত্তীর্ণ কোনো সাহিত্য জন্ম নেবে কিনা, তা সময়ই বলতে পারবে৷ সমাজ পরিস্থিতির প্রভাব সাহিত্য কখনই এড়াতে পারে না৷ ফলে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন এখন যে অস্থির সময় পার করছে, তার প্রভাবও সাহিত্যে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক৷
ফলে একদিকে কেউ কেউ ক্ষমতাসীন বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করে জনপ্রিয়তা ও আনুকূল্য পাওয়াটাকে মূল লক্ষ্য কের নিয়েছেন৷ অন্যদিকে অনেকে যা ইচ্ছা লিখে কোনঠাসা হওয়া বা হীরক রাজার দেশের গায়কের মতো ‘গর্তে পড়তে' চাওয়াটাও মানতে পারছেন না৷
কিন্তু এর ফল যা হচ্ছে, তাতে কী বাংলা সাহিত্যের কোনো বিশেষ উপকার হচ্ছে? পাঠকেরা নিজেদের রুচি অনুযায়ী বই বেছে নেবেন, কিন্তু সেই উন্মুক্ত বাজার সৃষ্টির পরিস্থিতি কী রয়েছে? আমার মনে হয় না৷
0 মন্তব্যসমূহ
মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।