বিশ্বের ইতিহাসে নানাজন নানা গুণে ও কর্মে অমর হয়ে আছেন। জীবদ্দশায় যেমন বিতর্কিত ছিলেন। তেমনই মৃত্যুর শত শত বছর পরে এসেও বিতর্ক সৃষ্টি করছে তাদের জীবনকাল এবং কর্ম। তেমনই একজনের কথা আপনাদের জানাবো আজ। তিনি একই সঙ্গে ভূপর্যটক, অনন্য পণ্ডিত এবং বন্দুক হাতে লড়াই করা সৈন্য। অনায়াসে বলতে পারতেন ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকার ২৯টি ভাষা। জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন বার বার। অপমানিত হয়েছেন, অশ্লীলতার দায় চেপেছে তার ঘাড়ে। কিন্তু সে সমস্ত কিছু ছাপিয়ে করে তিনি আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। তিনি রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন।

১৮২১ সালে ইংল্যান্ডের ডেভনের টোরকি নামের এক সমুদ্রশহরে জন্ম রিচার্ডের। বাবা জোসেফ নেটারভিল বার্টন ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক আধিকারিক। বাবা জন্মসূত্রে আইরিশ হলেও রিচার্ডের মা মার্থা বেকার ছিলেন ইংরেজ অভিজাত পরিবারের সন্তান। বাবার চাকরি সূত্রে রিচার্ডের ছেলেবেলা কেটেছে ভ্রাম্যমান অবস্থায়। সেইসূত্রেই তিনি এতোগুলো ভাষা শিখতে পেরেছেন।

রিচার্ডের প্রাথমিক শিক্ষা তাই ঘটে বাড়িতেই গৃহশিক্ষকদের কাছে। পরে ইংল্যান্ডে থিতু হলে তাকে ভর্তি করা হয় রিচমন্ডের একটি বিদ্যালয়ে। অল্প বয়সেই রিচার্ড আয়ত্ত করেন ফরাসি, লাতিন, নিয়াপোলিটান, ইটালিয়ান এবং ইউরোপের বেশ কিছু আঞ্চলিক কথ্যভাষাও। রিচার্ড ১৮৪০ সালে অক্সফোর্ডের ট্রিনিটি কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।

বিচিত্র গোঁফ রাখার কারণে তিনি সহপাঠীদের কাছে উপহাসের পাত্র ছিলেন। এক সময়ে ব্যাপারটা এমন তিক্ত অবস্থায় পৌঁছায় যে, এক সহপাঠীর সঙ্গে তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধেও অবতীর্ণ হন। ফলে কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। মামুলি জীবন রিচার্ডের বিশেষ অপছন্দ ছিল। তিনি বাবার মতোই যোদ্ধা হতে চাইতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদলে যোগ দেন এই আশায় যে, ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে তাকে পাঠানো হবে। তবে তত দিনে সেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। এদিকে বার্টন সেই সময়ে পৌঁছেও গিয়েছেন ভারতে।

ভারতে তাকে পোস্টিং দেওয়া হয় বম্বে নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি-তে। এই সময়ে তিনি হিন্দি, পঞ্জাবি, সিন্ধ্রি, গুজরাতি, মরাঠি, পারসিক ও আরবি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। বার্টন তার আত্মজীবনীতে জানিয়েছিলেন, তার হিন্দি শিক্ষক নাকি তাকে উপবীত ধারনেরও অনুমতি দেন।

বার্টন ক্রমে ‘দিশি’ হয়ে যাচ্ছেন-এই মর্মে অভিযোগ তোলা হয় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে। তখন রিচার্ড বেশ কিছু বানর পুষে তাদের ভাষা ‘রপ্ত’ করার চেষ্টা করছিলেন। এই সময়ে তার বিভিন্ন ধর্মের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। তিনি প্রথমে নাগর ব্রাহ্মণ হন, তারপর শিখ ধর্ম গ্রহণ করেন, পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সুফিদের কাদিরিয়া সিলসিলার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠতে থাকে।

ইসলামে তার ব্যুৎপত্তি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, তিনি সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ মুখস্থ বলতে পারতেন। ১৮৫৩ সালে রিচার্ড মক্কা ও মদিনা ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন ও মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে তিনি কায়রোতে পৌঁছান। সেই সময় তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ‘মির্জা আবদুল্লাহ্ বাশরি’ হিসেবে। এক সুফি দরবেশের ছদ্মবেশে তিনি আরবের ইয়াম্বুতে এবং তারপরে ‘জাইর’ ছদ্মনামে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন।

মক্কায় পবিত্র কাবা শরিফে তিনি প্রবেশ করেন এই ছদ্মবেশেই। প্রসঙ্গত, রিচার্ডই প্রথম ইউরোপীয় যিনি কাবা শরিফে প্রবেশ করেন। এরপর মক্কা থেকে তিনি জেদ্দা হয়ে কায়রোয় ফিরে আসেন। এই সময় ইংল্যাণ্ডের রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির অনুমোদন নিয়ে তিনি মিশর অতিক্রম করে ভৌগোলিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। সেনাবাহিনীর কাজ থেকে তিনি ছুটি নেন এবং হজযাত্রী হিসেবে আবার মক্কা ও মদিনায় গমন করেন। সেখানে তিনি হজ পালনও করেছিলেন।

১৮৫৪ সালে আডেন বন্দর হয়ে সোমালিল্যান্ড অঞ্চলে অভিযানে যান রিচার্ড। আফ্রিকা তখন ইউরোপীয়দের কাছে ‘আবিষ্কৃত’ হচ্ছে। এই অভিযানে রিচার্ড-সহ রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অন্য সদস্যদের উপর সোমালি যোদ্ধারা হামলা করে। তখন রিচার্ড গুরুতর আহত হন। এজন্য অবশ্য সোমালিল্যান্ড অভিযানের তিক্ত অভিজ্ঞতা মুছে ফেলে রিচার্ড আফ্রিকার এক অজানা অঞ্চলে প্রবেশের কথা ভাবেন। আফ্রিকার হ্রদ অঞ্চলকে ইউরোপীয়দের সঙ্গে পরিচয় করান এই অদ্ভুত স্বভাবের রিচার্ডই।

বিপুল অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি টাঙ্গানাইকা হ্রদে এসে পৌঁছান ১৮৫৮ সালে। অনেক কষ্ট স্বীকার করে তার নেতৃত্বাধীন অভিযাত্রী দল ভিক্টোরিয়া হ্রদে পৌঁছে সেটিকে নীল নদের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে। এজন্য ইতিহাসে ভৌগোলিক অভিযাত্রী হিসেবে রিচার্ডের খ্যাতি আজও অমলিন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন তার পাণ্ডিত্য ও লেখালেখি।

জানেন কি? বার্টনই প্রথম মিশরে থাকাকালীন সন্ধান পান আরব্য রজনীর গল্পমালার। তিনি সেগুলো সংগ্রহ করতে শুরু করেন এবং ১৭ খণ্ডে ‘দ্য বুক অব দ্য থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’ নামে তা প্রকাশিত হয় (১০খণ্ড মূল ও তার সংযোজন আরও সাত খণ্ড)। এই বিস্তৃত অভিযাত্রী জীবনে রিচার্ড প্রাচ্যের কামশাস্ত্র গ্রন্থগুলোর সঙ্গে পরিচিত হন। বাৎস্যায়ন বিরচিত ‘কামসূত্র’ তিনিই প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। আরবের কামশাস্ত্র (শেখ নেফাজি বিরচিত) ‘সুরভিত উদ্যান’ বা ‘দ্য পারফিউমড গার্ডেন’-ও তারই অনুবাদে ইউরোপে প্রবেশ করে।

সমকালীন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের কড়া রক্ষণশীল সমাজ কিন্তু রিচার্ড বার্টনকে ছেড়ে কথা বলেনি। ১৮৮৬ সালে স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়া তাকে নাইট উপাধি দিলেও, তার বিরুদ্ধে ‘অশালীনতা’ ও ‘পর্নোগ্রাফি’ রচনার অভিযোগ আনে ভিক্টোরীয় সমাজ। এমনকি, রিচার্ডের স্ত্রীও স্বামীর এই সব রচনাকে ভালো চোখে দেখতেন না।

রিচার্ডের স্ত্রী ইসাবেল আরুন্ডেল স্বামীর বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেন। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, তার মধ্যে ‘সুরভিত উদ্যান’-এর মূল পাণ্ডুলিপিও ছিল। আজ সেই নামে যা পাওয়া যায়, তা সেই মহাগ্রন্থের কয়েকটি অধ্যায়ের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অংশ মাত্র। জানা যায়, সেই সব পুড়িয়ে দেওয়া পাণ্ডুলিপির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সমকামিতা এবং অসমবয়সি পুরুষদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ ছিল। কিন্তু সমকালীন ইংল্যান্ডে এ সব লেখার অর্থ ছিল নিশ্চিত হাজতবাস। ইসাবেলা বোধ হয় ভয় পেয়েই সেই সব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেন।

রিচার্ড বার্টনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে ধরা হয় ‘কামসূত্র’ অনুবাদ। তিনি ইংল্যান্ডের সমাজে প্রাচ্যদেশীয় ‘ইরোটিক’ সাহিত্য আলোচনার জন্য ‘কামসূত্র সোসাইটি’ প্রবর্তন  করেন। এই কাজে তার সহযোগী ছিলেন ফ্রস্টার ফিৎজেরাল্ড আরবুথনট নামের এক ইংরেজ প্রাচ্যবিদ। সমকালীন আইনের চোখ এড়িয়ে এই সোসাইটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে প্রাচ্যদেশীয় যৌনভাবনা ও দর্শনের চর্চা চালিয়ে যান।

রিচার্ডের আরও এক উল্লেখযোগ্য কাজ হল ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’-র ইংরেজি অনুবাদ। সেই গ্রন্থ ‘বিক্রম অ্যান্ড দ্য ভ্যাম্পায়ার’ নামে প্রকাশিত হয়। এই অনুবাদ আজও পশ্চিমী বিশ্বে বিশেষ ভাবে আদৃত। সংস্কৃত ভাষাকে তিনি নিজের মাতৃভাষার মতোই জানতেন। শেষ জীবনে বার্টন কূটনৈতিক কাজে পশ্চিম আফ্রিকা সহ বহু দেশে একা থাকতেন। এই সময়েই তার স্বাস্থ্যভঙ্গ ঘটে।

ইতালির ত্রিয়েস্তে বাসকালে ১৮৯০ সালে রিচার্ড হৃদরোগে মারা যান। যদিও তিনি অসংখ্য বার ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন, তবু স্ত্রী ইসাবেলার ইচ্ছায় রোমান ক্যাথলিক মতেই তার অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হয়। শেষ বয়সে বার্টন নিজেকে ‘নিরীশ্বরবাদী’ বলতেন। ইসাবেলার প্রয়াণের পর রিচার্ডের কবর স্থানান্তরিত হয়। দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের মর্টলেকের এক সমাধিক্ষেত্রে তাদের দু’জনেরই সমাধি নির্মাণ করা হয়।

রিচার্ড বার্টনকে বিশ্বসাহিত্য বহু বিচিত্র উপায়ে মনে রেখেছে। আর্জেন্টিনার কালজয়ী সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস তার প্রখ্যাত গল্প ‘আলেফ’ শুরুই করেছিলেন রিচার্ড আবিষ্কৃত এক আয়নার কথা বলে, যে আয়নায় গোটা ব্রহ্মাণ্ড প্রতিফলিত হয়। বোর্হেসের এই গল্প পুরোটাই কল্পিত। কিন্তু স্যার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন যে এক অতুলনীয় ‘দার্শনিক’ ছিলেন, তারই সাক্ষ্য বহন করে এই শ্রদ্ধার্ঘ্য। সেই সঙ্গে তর্কে বিতর্কে জড়িয়ে আছেন এখনো তিনি।

সূত্র: ওড বাংলা