পল্লীকবি, বৃক্ষকবি, জাতিসত্ত্বার কবি, কিশোর কবি, তরুণ কবি, রাতের কবি, দিনের কবি এই ধরনের উপাধিকে “ফানি ব্যাপার” বলে উল্লেখ করেছেন কবি সাম্য রাইয়ান৷ গত ২৯ জুন ২০২১ খ্রিঃ তারিখে উত্তরে বাংলা পত্রিকার পক্ষ থেকে নেয়া সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন তিনি৷ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন সাংবাদিক ও ইঞ্জিনিয়ার সাইদুর রহমান সাগর৷ বাংলা সাহিত্যবার্তা পত্রিকার পাঠকদের জন্য আমরা সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করলাম৷ উত্তরে বাংলা পত্রিকার লিংক৷
আলোকচিত্রীঃ পারভেজ ইবনে সুলতান

বিশেষ সাক্ষাৎকারে কবি সাম্য রাইয়ান


কবিতা যাঁর ভাষা, শব্দই যার সাধনা তিনি কবি সাম্য রাইয়ান৷ গত দেড় দশকে লিখেছেন কবিতা, মুক্তগদ্য ও প্রবন্ধ৷ প্রকাশিত হয়েছে ‘চোখের ভেতরে হামিংবার্ড’ শীর্ষক কবিতার বই ও ‘লোকাল ট্রেনের জার্নাল’ শীর্ষক মুক্তগদ্যের বই৷ এছাড়াও একাধিক পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে যেমন ‘মার্কস যদি জানতেন’, ‘হলুদ পাহাড়’, ‘বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা’, ‘সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট’৷ ২০০৬ থেকে সম্পাদনা করছেন বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন ‘বিন্দু’ (প্রিন্ট ও অনলাইন বিন্দু)৷ তাঁর সাম্প্রতিক সাহিত্যকর্ম ও জীবনকথা নিয়ে আলোচনার জন্য মুখোমুখি হয়েছেন সাইদুর রহমান৷

সাইদুর রহমান সাগরঃ করোনার এই দীর্ঘ মহামারিতে আপনার সময় কেমন কাটছে, ভাই?

সাম্য রাইয়ানঃ করোনাকালীন পুরো সময়টাই এতোটা অস্থির চারদিক… এই সময় আমার প্রধান চেষ্টা ছিলো নিজেকে শান্ত রাখা৷ স্থির রাখা৷ এই সমাজব্যবস্থায় একজন সৎ লেখক/শিল্পীকে কতো রকম পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বিপন্নতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, বেঁচে থাকতে হয় ৷ কতোরকমভাবে নিজেকে ভাঁজ করতে হয়, নিজেকে বিপন্ন করতে তা সেই লেখক/শিল্পী ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না, কারো পক্ষেই না৷
উত্তর বাংলা পত্রিকার স্কিনশট

সাইদুর রহমান সাগরঃ নিজেকে কতোটা স্থির রাখতে পারলেন?

সাম্য রাইয়ানঃ পরিপার্শ্ব তো আর তা সহজেই হতে দিচ্ছে না৷ নানান প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে৷ এই অসুস্থ সোসাইটিতে হরেক রকম ক্রাইসিসের মুখোমুখি, এগুলো লেখালিখির জন্য স্বাস্থ্যকর ব্যাপার নয় আরকি৷

সাইদুর রহমান সাগরঃ লকডাউনের ঘরবন্দী সময়ে কী কী কাজ করলেন?

সাম্য রাইয়ানঃ ঘরবন্দী এই এক দেড় বছরে আমার জীবনে ঘরবন্দী থাকাটা প্রতিবন্ধকতা রূপে তেমন একটা নাই, কারন আমি নরমালিই দূরে কোথাও যাই না তেমন৷ এই সময়ে লেখার পরিমাণ বাড়েনি৷ নরমালি যেরকম লিখি সেরকমই, এক/দেড় বছরে বোধয় দশ-বারোটা কবিতা লিখেছি, মুক্তগদ্য লিখেছি তুলনামুলক বেশি— পাঁচটা বোধয় আর নিবন্ধ লিখেছি তিনটা বা চারটা৷ নিবন্ধগুলো সাহিত্যিক প্রসঙ্গে যেমন সেলিম মোরশেদ, মিজান খন্দকার, মারুফুল আলম…৷ আর অনলাইনে বিন্দুর কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেছি৷ এর মধ্যে অবরুদ্ধ সময়ের ভাবনা, মহামারীদশার আধ্যান, উৎপলকুমার বসু সংখ্যা ও মাসুমুল আলম সংখ্যা উল্লেখযোগ্য৷ 
 
সাইদুর রহমান সাগরঃ কবিতার উপাদান আপনি কীভাবে খোঁজেন?

সাম্য রাইয়ানঃ পিকাসোর একটা উক্তি আছে—‘I don’t search, I find.’ মানে ‘আমি খুঁজি না, আমি পাই।’ তোমার প্রশ্ন শুনে পিকাসোর কথাটা মনে পড়লো৷ সম্ভবত অনুসন্ধানী মন অবচেতনে সর্বদাই অ্যাকটিভ থাকে, আর টুকে রাখে… 

সাইদুর রহমান সাগরঃ ‘লোকাল ট্রেনের জার্নাল’ গ্রন্থের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাই৷

সাম্য রাইয়ানঃ গদ্য লিখি অনেকদিন৷ মুক্তগদ্য লিখছি প্রায় দশ বছর৷ দুই হাজার এগারোতে বিশেষ ধরণের মুক্তগদ্য লিখতে শুরু করি, এগুলো কবিতা নিয়ে, কিন্তু কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা নয়, বরং কবিতা পড়তে পড়তে আমার মধ্যে যে ভাবের উদয় হয়েছে, যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে তারই বর্ণনা৷ অকপটে গদ্যের শরীরে সংযুক্ত করেছি অ-নে-ক কবির কবিতাংশ৷ কোনো কবিতা পড়ার সময় হয়তো আমার ছেলেবেলার কোনো ঘটনা মনে পড়েছে বা কোনো এক রাতের দৃশ্য মনে পড়েছে, কিংবা নতুন কোনো চিত্রকল্প ভেবেছি সেইসবই বর্ণনা করে গেছি৷ ফলে এ গদ্য কখনো কবিতার মতো এগিয়েছে আবার কখনো গল্প, আবার কখনো প্রবন্ধের রূপ ধারণ করছে হয়তো এক/আধখানা অনুচ্ছেদে৷ এরকমই হয়েছে৷ এই ধরণের গদ্যগুলো ‘কবিতা বনাম কবিতা–কবিতা খেলা সিরিজ’ নামে প্রকাশ করেছিলাম বিভিন্ন লিটলম্যাগে৷

এছাড়াও কিছু মুক্তগদ্য আছে যেগুলো নীরেট অনুভূতি দিয়ে গাঁথা৷ প্রলাপও বলতে পারো৷ অন্ধকারের কুঠুরীতে বসে বকে যাওয়া কথামালা৷ জলের তরঙ্গ কিংবা শিশির-বিন্দু-প্রবাহের অনুভূতি তৈরি করবে মনে৷ এইসব বেখেয়ালী রচনাকতক— আসলে একটা জার্নি— এই ট্রেন তোমাকে নির্দিষ্ট কোথাও পৌঁছে দেবে না, বরং যেতেই থাকবে৷ যতক্ষণ তোমার ইচ্ছে হবে যাত্রা করবে, কোনো রূপে আটকে গেলে ট্রেন থেকে নেমে যাবে— এটা তো লোকাল ট্রেন…

সাইদুর রহমান সাগরঃ অনেকে মনে করেন আপনি প্রেমের কবি৷ এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

সাম্য রাইয়ানঃ এইটা একটা গন্ডি৷ এরকম উপাধি-টুপাধি দিয়ে লেখককে আসলে একটা ছোট্ট গন্ডিতে আটকে ফেলা হয়৷ যেমন ধরো নজরুলকে বলতেছে বিদ্রোহী কবি, তাহলে নজরুলের যে এত এত প্রেমের কবিতা বা ভক্তিমূলক কবিতা সেইসবের কী হবে? কিংবা ধরো পল্লীকবি, বৃক্ষকবি, জাতিসত্ত্বার কবি, কিশোর কবি, তরুণ কবি, রাতের কবি, দিনের কবি এইসব খুবই ফানি ব্যাপার৷ কবির নামের সাথে কেউ কেউ যেমন ‘বিশিষ্ট’ শব্দটি যুক্ত করে বিশিষ্টতা আনয়ন করতে চায়! কিন্তু এতে করে কী বিশিষ্টতা যুক্ত হয় তা আমার বোধগম্য নয়৷ কবির সাথে ঐসব যুক্ত করে তাকে আটকে ফেলার মানে হয় না৷ কবি নানান বিষয় নিয়ে লিখে থাকেন, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা সাবজেক্টে তাকে আটকে ফেলাটা ভুল৷ ক্ষতিকরও৷ আমার ক্ষেত্রে এইটা কিছু লোক হয়তো বলে হামিংবার্ডের কারনে৷ 

সাইদুর রহমান সাগরঃ আপনি একটি কবিতার বই গণঅর্থায়নে প্রকাশ করেছিলেন৷ এই ব্যাপারে জানতে চাই৷

সাম্য রাইয়ানঃ হ্যাঁ, ‘মার্কস যদি জানতেন’৷ এটা আসলে নিজেকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা৷ এই যে এত বছর ধরে লিখলাম৷ নিজের পুস্তিকাসব নিজেই প্রকাশ করেছিলাম৷ মধ্যখানে দু'টো বই ঘাসফুল প্রকাশ করেছে৷ তো এই জার্নিতে আমার মনে হলো একটা পুস্তিকা পাঠকের টাকায় প্রকাশ করবো৷ আসলে দেখতে চেয়েছিলাম, পাঠক বলতে কিছু আছে কী না আমার কবিতার৷ আমি খুব সচেতনভাবেই বন্ধু বা পরিচিতজনদের কাছে টাকা নেইনি৷ খোলা আহ্বান রেখেছিলাম শুধুমাত্র পাঠকদের কাছে৷ এবং আশাতীত সাড়া পেয়েছিলাম৷ ফলস্বরূপ ‘মার্কস যদি জানতেন’ পাঁচশ' কপির পরিবর্তে এক হাজার কপি ছাপা হয়৷

সাইদুর রহমান সাগরঃ আগামীতে বই প্রকাশের ব্যাপারে পরিকল্পনা কী এই মুহূর্তে?

সাম্য রাইয়ানঃ পঞ্চান্ন পর্বের একটা সিরিজ কবিতা আছে ‘লিখিত রাত্রি’ শিরোনামে৷ ২০১৫ এ এই পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলাম৷ এটা ছাপার ইচ্ছা আছে৷ আর ‘হলুদ পাহাড়’ নামে একটা দেড় ফর্মার পুস্তিকা আছে, ঐটা রিপ্রিন্ট করবো ভাবছি৷ আর নতুন কিছু কবিতা আছে, এগুলো নিয়ে এখনো কিছু ভাবিনি৷ 

সাইদুর রহমান সাগরঃ সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই৷

সাম্য রাইয়ানঃ তোমাকেও ধন্যবাদ। ভালো থেকো, সাবধানে থেকো৷